Thursday, April 2, 2020

স্মৃতি- বিস্মৃতির জীবন : বেতার পর্ব ৫

হাসান মীরের স্মৃতি- বিস্মৃতির জীবন : বেতার পর্ব ৫

১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে আমি বাংলাদেশ বেতার, রাজশাহী কেন্দ্রের বার্তা বিভাগে সাব-এডিটর ছিলাম। এই পর্বের আগের এক লেখায় উল্লেখ করেছি, তখন আমাদের কোনো সংবাদদাতা বা জেলা প্রতিনিধি ছিলেন না, রাজশাহীতে কোনো দৈনিক পত্রিকা ছিল না, ঢাকার পত্রিকা আসতো বিকেলে কিংবা সন্ধ্যায়। সর্বোপরি কেবল সরকারি বা একান্ত নির্ভরযোগ্য সূত্র, যেমন সরকার দলীয় এম. পি, ছাড়া খবর নেয়াও যেতো না। ফলে সামান্য পাঁচ মিনিটের একটি বুলেটিনের জন্যে প্রায় রোজই জেলা ও মহকুমা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হতো।


ওই সময় রাজশাহীতে একজন ডিসি বা জেলার ডেপুটি কমিশনার ছিলেন (সাধারণভাবে জেলা প্রাশাসক নামে পরিচিত, যদিও প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মচারী জনগণের 'প্রশাসক' বা শাসক হওয়ার কথা নয়) তাঁর নাম ছিল আহমদ আবদূর রউফ। তিনি ছিলেন একজন স্মার্ট ও হ্যান্ডসাম অফিসার, ভিন্ন একটি ব্যাপারে তাঁর কথা মনে আছে। তাঁর ছিল দুজন সুন্দরী স্ত্রী। অনেকেই নাকি ডিসি সাহেবকে তাঁর দুই বেগমকে নিয়ে পদ্মার তীরে বেড়াতে দেখেছে। আমি দুই একটি অনুষ্ঠানে তাদের দুজনকে দর্শক আসনের প্রথম সারিতে পাশাপাশি বসতে দেখেছি। সপত্নী বা সতীনদের মধ্যে এমন সুসম্পর্ক হয় বলে আগে জানা ছিল না ।

জেলার ডিসি সাহেবদের পদমর্যাদা বোধকরি উপসচিব বা যুগ্মসচিব পর্যায়ের। কিন্তু জেলার সার্বিক দায়িত্ব থাকায় তাঁদের যেমন হাজার রকমের দায়িত্বপালন করতে হয় তেমনি সুযোগ সুবিধা এবং মর্যাদাও বেশি ভোগ করেন। তবে সবার হাঁকডাক সমান হয় না। সাইদুর রহমান নামে এক ডিসি ছিলেন বড়ই সাদাসিধে ধরণের। তিনি এখান থেকে সচিবালয়ে ফিরে যাওয়ার পর আমি একবার অফিসের কাজে ঢাকায় গিয়ে সেগুনবাগিচার চিটাগাং হোটেলে উঠেছি। পরদিন সকালে রমনা পার্কের মধ্যে দিয়ে হেঁটে শাহবাগ যাওয়ার সময় সাইদুর রহমান সাহেবকে হাঁটতে দেখে সালাম দিলাম। সাধারণ শার্ট- প্যান্ট, পায়ে কেডস। সঙ্গে পাইক- বরকন্দাজ নেই। আমাকে তাঁর মনে রাখার কথা নয় তবু পরিচিতজনের মতোই কুশল জানতে চাইলেন।
একসময় রাজশাহীতে সম্ভবত আমিনুল ইসলাম নামে একজন বিভাগীয় কমিশনার ছিলেন। ভদ্রলোকের সবই ভালো তবে বক্তব্য দিতে উঠলে অবধারিতভাবে বলতেন "আপনারা হয়তো জানেন না - -"। তিনি অবশ্যই বেশি জানতে পারেন কিন্তু অন্যদের জ্ঞান সম্পর্কে এভাবে সংশয় প্রকাশ করা আমার ভালো লাগেনি।
ওই সময় নাটোরে একজন এসডিও ছিলেন ইউনুস আলী। মাঝে মাঝে রসিকতা করতেন। একদিন আমি খবরের খোঁজ নিতে ফোন করেছি। তিনি বললেন - খবর আছে, খবর নাই। আমি কারণ জানতে চাইলে বললেন - খবর কিছু আছে কিন্তু ঝামেলার খবর, রেডিওতে প্রচার করা যাবে না।
১৯৭৭-৭৮ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহীতে একজন অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার (ADC General) ছিলেন আবদুল হামিদ। জেলা প্রশাসনের অধিকাংশ খবর পাওয়া যেতো জেনারেল শাখাতেই, আমিও প্রায়ই ফোন করতাম। একদিন হঠাৎই বললেন - এদিকে এলে দেখা করবেন, কথা আছে। কদিন বাদে ডিসি অফিসের পাশেই জেলা পরিষদের মণিরউদ্দিন মিলনায়তনে বড়সড় কোনো সভা । আমি গেছি রিপোর্টিং' এ। বক্তৃতা পর্ব তখনও শুরু হয়নি। হামিদ সাহেবকে দেখে এগিয়ে গিয়ে সালাম দিয়ে পরিচয় দিলাম। তিনি কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন: হিসাব মিললো না। আপনার কণ্ঠস্বরে ভেবেছিলাম ইয়ং - হ্যান্ডসাম কেউ হবে, কিন্তু আপনিতো .... তিনি হাসলেন। আমিও মনেমনে হাসলাম। লেজ দেখেই যেমন শেয়াল না বেজি বোঝা যায় না, তেমনি টেলিফোন ব্যবহারের প্রথম দিকে গলা শুনে অপরপ্রান্তের মানুষটি যে মেয়ে নাকি মেয়ের মা অথবা কাজের বুয়া - আমিও বুঝতাম না।

অনেক বছর পরে ১৯৯০ - ৯১ খ্রি. টোকিওতে রেডিও জাপানের বাংলা সম্প্রচার বিভাগে কাজ করার সময় বাংলাদেশ দূতাবাসের সম্ভবত দ্বিতীয় সচিব মিজারুল কায়েস সাহেবের (১৯৮২ ব্যাচের বিসিএস?) সঙ্গে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছিল। আমি রাজশাহীতে থাকি শুনে বললেন - আমার আব্বা রাজশাহীতে এডিসি ছিলেন, পরে বরিশালের ডিসি হিসাবে রিটায়ার করেন। হামিদ সাহেবের নাম শুনে আমি তাঁকে সেই পুরনো গল্পটি শুনিয়েছিলাম। শুনে কায়েস সাহেব খুব মজা পেলেন। (পরে রাজশাহী কলেজের সাবেক অধ্যাপক গোলাম কবির সাহেবের কাছে শুনেছি - কায়েস সাহেব এই কলেজে তাঁর ছাত্র ছিলেন)।
মিজারুল কায়েস ছিলেন, আমরা যাদের বলি ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাট। তিনি এক পর্যায়ে পররাষ্ট্র সচিব হয়েছিলেন। তিনি প্রচুর পড়াশুনা করতেন, শিল্প- সাহিত্য - সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আগ্রহ ছিল। পরে কী কারণে জানি না চাকরিক্ষেত্রে তাঁর এক ধরণের পদাবনতি ঘটে। তিনি সচিব থেকে প্রথমে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের হাইকমিশনার ও পরে ব্রাজিলে রাষ্ট্রদূত ছিলেন। এই পর্যায়ে তাঁর শারীরিক পরিবর্তন ঘটেছিল। আমি টোকিওতে তাঁকে স্বাভাবিক চেহারায় দেখেছিলাম কিন্তু পরের দিকে তাঁকে জাপানের সুমো পাহলোয়ানদের মতো দেখাতো। এই অস্বাভাবিক স্বাস্থ্যের কারণেই তিনি হয়তো নানান অসুখে ভুগছিলেন। ২০১৭' র ১০ ই মার্চ তিনি ব্রাজিলেই ইন্তেকাল করেন, মৃত্যুর কারণ হিসাবে বলা হয়েছিল multiple organ failure. পরে তাঁকে দেশে এনে দাফন করা হয়। করুণাময় আল্লাহ্‌ তাঁকে শান্তিতে রাখুন । 
[পুরনো লেখা।]
হাসান মীর ভাইয়ের ফেসবুক পাতা থেকে সকলের জন্য তুলে ধরা হলো




Readers' Choice