Friday, April 3, 2020

ধান ভানতে শীবের গীত । ১২

NHK World রেডিও জাপানের বাংলা সম্প্রচারের ৫৯ বছর।

সূচনা- লেখ : 


রেডিও জাপান - NHK World ' এর বাংলা সার্ভিসের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে গত ২৬শে মার্চ আমার ফেসবুকের পাতায় পোস্টটি প্রকাশিত হয়েছিল। এই লেখায় বাংলা সার্ভিসের প্রধান উদ্যোক্তা এবং রেডিও জাপান থেকে প্রচারিত বাংলা অনুষ্ঠানের প্রথম ঘোষক শেখ আহমদ জালাল সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য থাকলে ভালো হতো বলে একজন পাঠক অনুযোগ করেছিলেন। সত্যি বলতে কি, আমার নিজের সামর্থের সীমাবদ্ধতার কারণে সেই কাজটি করা যায়নি। তবে জাপান - প্রবাসী সাংবাদিক Kazi Ensanul Hoque'এর সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা গেলো, শেখ জালাল সাবেক পাকিস্তান আমলে উচ্চশিক্ষার জন্য টোকিও যান।
তিনি জাপানি ভাষায় ডিপ্লোমা এবং মাইনিং প্রকৌশল বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। ১৯৭১ খ্রীস্টাব্দে তিনি টোকিওতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত গঠন ও প্রচার - প্রচারণায় ভূমিকা পালন করেন। তিনি ওই সময় জাপানি পত্র- পত্রিকায় প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের খবর ও চিত্র, নিউজ ক্লিপ, জনগণের মতামত, বক্তৃতা - বিবৃতি ও অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে সেগুলি ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষণের জন্য দেওয়া হয়েছে। বিখ্যাত সাহিত্যিক শংকরের ' এপার বাংলা ওপার বাংলা ' গ্রন্থে রেডিও জাপান থেকে বাংলা অনুষ্ঠান সম্প্রচারে শেখ জালালের ভূমিকার উল্লেখ রয়েছে বলে শুনেছি।

স্বাধীনতা


উত্তর বাংলাদেশে শেখ আহমদ জালাল কিছুদিন সাংবাদিকতার পেশায় নিয়োজিত ছিলেন, পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাকরিতে যোগ দেন। তিনি টোকিওর বাংলাদেশ দূতাবাস ও কলকাতায় উপ- দূতাবাস এবং সার্ক সচিবালয়ে দায়িত্বপালন করেছেন। এছাড়াও তিনি জাপান ফাউন্ডেশনের অনারারি ফেলো ছিলেন। তিনি কয়েকটি শিশুতোষ গ্রন্থ রচনা ও অনুবাদ করেন। কাজী ইনসানুল হকের দেওয়া তথ্য মতে, ২০০৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে সেপ্টেম্বর তিনি ইন্তেকাল করেন। এবার আসুন, রেডিও জাপান - NHK World'এর প্রতিষ্ঠা বার্ষিক উপলক্ষে লেখা পোস্টটি পড়ে দেখা যাক।

প্রাচীনতম সম্প্রচার প্রতিষ্ঠান

জাপানের প্রাচীনতম সম্প্রচার প্রতিষ্ঠান NHK ( Nippon Hoso Kyokai বা ইংরেজিতে Japan Broadcasting Corporation ) ' এর অঙ্গ সংগঠন রেডিও জাপানের বাংলা সম্প্রচারের ৫৯ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ তেসরা এপ্রিল। আপনারা জানেন জাপানিরা তাদের নিজেদের দেশটাকে বলে নিপ্পন (Nippon ) বা নিহন ( Nihon) যার অর্থ সূর্য থেকে সৃষ্ট আর এশিয়ার পূর্বপ্রান্তের দেশ বলে আমরা জাপানকে বলি সূর্যোদয়ের দেশ, অর্থাৎ যে দেশে প্রথম সূর্য ওঠে।


জাপানে সরকারি উদ্যোগে সম্প্রচার ব্যবস্থার সূচনা ১৯২৬ সালের ৬ ই অগাস্ট তখন নাম ছিল রেডিও টোকিও। এরপর বিধিবদ্ধ আইনের আওতায় NHK নামে যাত্রা শুরু হয় ১৯৩৫ সালের পয়লা জুন। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের 9 এবং দেশটি আমেরিকার দখলে চলে যাওয়ায় ছয় বছরের বেশি NHK ' এর সম্প্রচার বন্ধ ছিল ১৯৫২ সালে পুনরায় এর যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে NHK' এর রয়েছে একাধিক টিভি চ্যানেল ( NHK World স্যাটেলাইট চ্যানেলে বাংলাদেশেও দেখা যায় ) আর রেডিও জাপান নামে রেডিওর হোম সার্ভিস, FM আর SW রেডিও। শর্টওয়েভে রেডিও জাপান বাংলা, হিন্দি উর্দুসহ মোট ১৮ টি ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার করে থাকে। বাংলা অনুষ্ঠান শর্টওয়েভে বাংলাদেশে সন্ধ্যা ৭ টা থেকে ৭-৪৫ মি. এবং এফ এম ব্যান্ডে ৭ টি বিভাগীয় শহরে রাত ৯.০০ টা থেকে ৯.৪৫ পর্যন্ত শোনা যায়। জাপানে পরীক্ষামূলক TV সম্প্রচার শুরু হয়েছিল ১৯৫০ সালে।

বাংলা অনুষ্ঠান


এবার বাংলা অনুষ্ঠানের খবর। রেডিও জাপানে বাংলা সম্প্রচারের শুরু ১৯৬১ সালের তেসরা এপ্রিল। এখানে একটা মজার ঘটনা আছে। তখন পাকিস্তানি ভাষা হিসেবে উর্দু ভাষার অনুষ্ঠান প্রচার হতো। টোকিওতে অধ্যয়নরত শেখ আহমেদ জালাল নামে একজন পূর্ব পাকিস্তানি বাঙালি ছাত্র এ নিয়ে প্রথমে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলেন, বাংলা আর উর্দু দুটোই যখন পাকিস্তানের সরকারি ভাষা তখন উর্দুর পাশাপাশি বাংলায় অনুষ্ঠান নয় কেন? তিনি এ নিয়ে NHK কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বললেন। তারা জানালো - বিষয়টি সরকারি পর্যায়ে উত্থাপন করতে হবে এবং সরকারি সিদ্ধান্ত হলেই কেবল তারা বাংলা ভাষার অনুষ্ঠান চালু করতে পারেন। তখন টোকিওতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন বগুড়ার মোহাম্মদ আলী (Mohammed Ali of Bogra, তিনি এক সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন)। শেখ জালাল কয়েকজন সঙ্গী- সাথী নিয়ে দূতাবাসে গিয়ে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের আরজি জানালেন। রাষ্ট্রদূত বললেন - লিখিত দরখাস্ত দাও, আমি পররাষ্ট্র দপ্তরের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেবো। তাই হলো। শেখ জালালের দরখাস্ত এক পর্যায়ে NHK কর্তৃপক্ষের হাতে পৌছালো। তারা শেখ জালালকে ডাকলেন। উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষাতেও ১৫ ( কিংবা ২০) মিনিটের অনুষ্ঠান প্রচারের সিদ্ধান্ত হলো। প্রথম ঘোষক বা পাঠক নির্বাচিত হলেন শেখ জালাল নিজেই। তারিখটি ছিল ১৯৬১ সালের তেসরা এপ্রিল। ( এরপর দৈনিক আধ ঘন্টা এবং ১৯৯১ সালের জানুয়ারিতে কিছুদিনের জন্য অতিরিক্ত আধঘণ্টার প্রভাতী অধিবেশন চালু হয়েছিল। এখন প্রচারিত হচ্ছে ৪৫ মিনিটের অনুষ্ঠান ) ।
শেখ জালাল পরবর্তীকালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বপালন করেছেন। ২০০১ সালে রেডিও জাপানের বাংলা বিভাগের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ঢাকার আগারগাঁয়ে বাংলাদেশ বেতার ভবনের সম্মেলন হলে যে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছিল, সেখানে তার সাথে আমার দেখা ও কথা হয়। সেদিন তিনি স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে পুরনো দিনের গল্প শুনিয়েছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে আমার আগে রেডিও জাপানে কর্মরত ফারুক হোসেনও অংশ নেন। (আমি রেডিও জাপানের বাংলা বিভাগে কাজ করেছি ফেব্রু. ১৯৮৮ থেকে অগাস্ট ১৯৯১ পর্যন্ত)। আমি যেসব অনিয়মিত শিল্পী/ উপস্থাপকদের সঙ্গে কাজ করেছি তাদের মধ্যে অনোয়ারুল করিম, অজন্তা গুপ্ত আর নাজনীন রহমান এখনো রয়েছেন বলে জানি। ইসকান্দার আহমদ চৌধুরী প্রয়াত, কল্যাণ দাসগুপ্ত যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আর জয়শ্রী চট্টোপাধ্যায় কলকাতায় অবসর জীবন কাটাচ্ছেন । আমি যখন ছিলাম, রেডিও জাপানের দক্ষিন- এশিয়া বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন হিরোফুমি সাতো। বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন কাজুমা হানাওয়া ( অবসরপ্রাপ্ত) আর দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে ছিলেন কাজুহিরো ওয়াতানাবে। মিঃ ওয়াতানাবে অবসরগ্রহণের পর সম্ভবত এখনও বাংলা বিভাগের সঙ্গে পরামর্শক হিসাবে যুক্ত রয়েছেন । এ ছাড়াও তিনি টোকিও বিদেশী ভাষা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাভাষার খণ্ডকালীন শিক্ষকের দায়িত্বপালন করে থাকেন । তাদের সবাই এবং এখন বাংলা বিভাগের সঙ্গে জড়িত সকলকে প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা বার্ষিক উপলক্ষে আমার আগাম শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন । রেডিও জাপানের পরমায়ু শতগুণ বৃদ্ধি পাক। 

।। পুরনো লেখা, পরিমার্জিত।। তথ্যবিভ্রান্তি থাকলে পাঠক দয়া করে জানাবেন l

হাসান মীর ভাইয়ের ফেসবুক পাতা থেকে সকলের জন্য তুলে ধরা হলো

Readers' Choice