রুশী ইতিহাসের রহস্য পর্ব ১ সের্গেই কিরভ এর মৃত্যু রহস্য |
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর নতুন বাতাবরনের শ্রোতাপ্রিয় অনুষ্ঠান ভয়েস অফ রাশিয়ার একটা
জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল রুশি ইতিহাসের রহস্য। ধারাবাহিক এই অনুষ্ঠানের মধ্যে দু’একটা
আমর অন্য একটা ব্লগ সাইটে তুলে রেথেছিলাম। মজার কথা অনেত পরে দেখেছি অনেক ব্লগসাইট
এবং মিডিয়াও আমার ওখান থেকে ব্যবহার করেছিলেন। রুশী
ইতিহাসের রহস্য পর্ব ১ এ আজকে সের্গেই কিরভ এর মৃত্যু নিয়ে করা
অনুষ্ঠানটা তুলে ধরছি।
রুশী ইতিহাসের রহস্য পর্ব ১ – প্রতিহিংসা চরিতার্থ নাকি স্তালিনের চক্রান্ত ?
১৯৩৪ সালের ১লা ডিসেম্বর লেনিনগ্রাদে(অধুনাতন সেন্ট-পিটার্সবার্গে)
সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির জেলা কমিটি ভবনে গুলির আওয়াজ শোনা গেল. নিজের
ক্যাবিনেটের চৌকাঠে খুন হলেন লেনিনগ্রাদের কমিউনিস্টদের নেতা ও সোভিয়েত একনায়ক
জোসেফ স্তালিনের ব্যক্তিগত বন্ধু সের্গেই কিরভ. আততায়ীকে অপরাধস্থলেই ধরা হয়. দেখা
গেল, যে সে পার্টির লেনিনগ্রাদ জেলা কমিটির প্রাক্তন
কর্মী লেওনিদ নিকোলায়েভ.
সের্গেই কিরভ |
২রা ডিসেম্বর সোভিয়েত সংবাদপত্রগুলিতে
প্রকাশিত হল মৃত্যুর বিজ্ঞপ্তি. সেখানে লেখা হল, যে
সের্গেই কিরভ খুন হয়েছেন বিপ্লবের শত্রুদের চক্রান্তে. এইভাবেই একক খুনীর সম্ভাবনা
সটান খারিজ করে দেওয়া হল. খুনের দিনই আবির্ভাব হল সন্ত্রাসের মামলার ত্বরাণ্বিত ও
সরলীকৃত বিচারের আইন. ফলশ্রুতিতে ঐ আইনটি স্তালিন পরিচালিত রাজনৈতিক নির্যাতন
চালানোর জন্য মোক্ষম যন্ত্রে পরিণত হয়েছিল. শুধু নিকোলায়েভকেই নয়, তার
পরিচিতদেরও সন্ত্রাসবাদের জন্য অভিযুক্ত করা হল. তদন্তের ভাষ্য
মতো, স্তালিনের রাজনৈতিক বিরোধী – পার্টির
শীর্ষস্থানীয় কর্মী জিনোভিয়েভ এবং কামেনেভ হত্যাকান্ডের পেছনে কলকাঠি
নাড়িয়েছিলেন. সোভিয়েত ইউনিয়নের সুপ্রীম কোর্ট এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে, ২৯শে
ডিসেম্বর নিকোলায়েভ ও অন্যান্য অভিযুক্তদের গুলি করে হত্যা করার আদেশ জারি করলো. ঐ
একই সময়ে মস্কোয় জিনোভিয়েভ ও কামেনেভকে গ্রেফতার করা হল. তাদের গুলি করে হত্যা করা
হবে কিছু পরে, ১৯৩৬ সালে.
তবে
তখনই কানাঘুষো শোনা যেতে লাগলো, যে শাসকরাই অপরাধে জড়িত আর কিরভের মৃত্যু
জিনোভিয়েভ ও কামেনেভকে খতম করার জন্য দীর্ঘপ্রতীক্ষিত অজুহাত মাত্র. বাস্তবিকই ঐ
ঘটনায় ব্যাখ্যাতীত অনেক কিছুই ছিল. হত্যাকান্ডের অনতিকাল পূর্বে এনকেভেদের(পরবর্তীকালে
নামান্তরকরণে কেজিবির)কর্মীরা কিরভের বাসগৃহের পাশে নিকোলায়েভকে আটকেছিল, তার
কাছে রিভলভার পাওয়া গেছিল, কিন্তু তারা তখনই নিকোলায়েভকে ছেড়ে দিয়েছিল. ১লা
ডিসেম্বর আততায়ী বিনা বাধায় প্রহরাপ্রাপ্ত ভবনে ঢুকে পড়ে, দীর্ঘক্ষণ
অলিন্দে তার নিশানার লক্ষ্যব্যক্তিটির জন্য অপেক্ষা করে, কিন্তু
কেউ তার প্রতি মনোযোগ দেয়নি. কিরভের ক্যাবিনেটের বাইরে ডিউটি দিতে বাধ্য প্রহরীটি
যথাসময়ে জায়গায় ছিল না. তাকে জেরা করে ওঠা যায়নি. তদন্তকারীর কাছে যাওয়ার সময় সড়ক
দুর্ঘটনায় সে মারা যায়. বড্ড বাড়াবাড়ি রকমের হেঁয়ালি নয় কি ?
কিছুকাল
পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের শীর্ষনেতার পদে বহাল থাকা কালে স্তালিনের উত্তরসূরী নিকিতা
খ্রুশোভ কিরভের হত্যাকান্ডে স্তালিনের লিপ্ত থাকার কথা প্রকাশ্যে বলেছিলেন.
সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির বিংশতম কংগ্রেসে স্তালিনের ব্যক্তিত্ব পুজার
মুখোশ খুলে দেওয়ার অন্যতম যুক্তি ছিল উপরোক্ত অভিযোগ. কিন্তু দোষ প্রমাণকারী কোনো
তথ্য শেষ অবধি পাওয়া যায়নি. সত্যি কথা বলতে কি, ঐ সব
তথ্যাবলী সেই ত্রিশের দশকেই হয়তো বিলোপ করে দেওয়া হয়েছিল.
কয়েক
বছর আগে সাড়াজাগানো এক ঘটনা ঘটে. কৃত অপরাধের ঠিক ৭৫ বছর পরে ২০০৯ সালের ১লা
ডিসেম্বর নিকোলায়েভের ডায়েরীর উপর থেকে গোপনীয়তার তকমা তুলে নেওয়া হয়. দিনলিপির
বয়ান অনুযায়ী নিকোলায়েভ ছিল মানসিক ভারসাম্যহীন. সে কমিউমিস্ট পার্টির লেনিনগ্রাদ
জেলা কমিটিতে ইনস্ট্র্যাকটরের সামান্য পদে চাকরি করতো এবং একাধিকবার শৃঙ্খলাভঙ্গের
দায়ে পদচ্যুত হয়েছিল. সে লেনিনগ্রাদের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কিরভকে অভিযোগ
জানিয়ে চিঠি লিখতো, কিন্তু কোনো উত্তর পায়নি. তারপরেই তার বদ্ধমূল
ধারণা জন্মেছিল, যে তার সমস্ত লাঞ্ছনার জন্য কিরভই দায়ী এবং সে
কিরভকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল. সন্ত্রাসবাদীটি লিখেছিল, যে সে প্রতিশোধ
নেবে, শহীদের মৃত্যু বরণ করবে ও ইতিহাসে স্থান করে
নেবে. ইতিহাসে সে ঠাঁই করে নিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু
ঐ কুকর্মের পরিণতি নিকোলায়েভ ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনি. শুধু তাকেই নয়,
ফলশ্রুতিতে তার স্ত্রী ও বন্ধুবান্ধবদেরও চক্রান্তের অভিযোগে গুলি করে
মারা হয়েছিল. ১৯৩৪ সালের ১লা ডিসেম্বরে ছোঁড়া ভাগ্যনির্ণায়ক গুলি ছিল সেই ‘বিশাল
রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে’র প্রথম বিয়োগান্তক ঘটনা, যার
দরুন লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ও ভাগ্য দুমড়ে মুচড়ে ভাঙা হয়েছিল।
নিকোলায়েভের ডায়েরী
এমনকি
নিকোলায়েভের ডায়েরী পড়ার পরেও বহু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে. কেন কিরভের বাড়ির পাশে
সশস্ত্র লোকটিকে হেফাজতে নিয়েও এনকেভেদের কর্মীরা দ্রুত তাকে ছেড়ে দিয়েছিল ?
কেন তার ক্যাবিনেটের কাছে প্রহরী অনুপস্থিত ছিল ? কিরভের
দেহরক্ষী বরিসভের আকস্মিক মৃত্যু কি ছিল সত্যিই কাকতালীয়
ঘটনা ? আর সবশেষে, নিকোলায়েভ
কি সত্যিই ছিল মানসিক ভারসাম্যহীন একাকী-খুনী, নাকি
তাকে সুকৌশলে চালনা করে কাজ হাসিল করা হয়েছিল ? খুব
সম্ভবতঃ আমরা কোনোদিনও আসল সত্য জানতে পারবো না।
আরও রুশী ইতিহাসের রহস্য- পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩
First Publication Date: 24 May 2013 | Revised Publication Date: 15 February 2020
Source: http://bengali.ruvr.ru/2013_05_24/114134085/ (এখন পেইজটি নেই)