হাসান মীর |
জনাব হাসান মীর- কে নিয়ে বলার মতো ভাষা বা দক্ষতা কোনটাই আমার নেই। বাংলাদেশ বেতারের বার্তা বিভাগ ও তারও আগে রেডিও পাকিস্তানের একজন দক্ষ বেতার সেনানী তিনি। মাঝে রেডিও জাপানের বাংলা বিভাগে কাজ করায়, আমার মতো বেতার প্রেমিকের সৌভাগ্য হয় এমন মহান একজন মানুষের সাথে। ইনাহারা- সান-এর সাথে ডিনার তার একটা পুরোনো লেখা যেটি আজ রাত ১২টার পর তাঁর ফেসবুক-এ পোষ্ট করেছেন।
আমি পরম সৌভাগ্যবান, এই মানুষটিকে , আমার শখের রাজ্যে পথ প্রদশর্ক হিসেবে পাওয়ার।
ধান ভানতে শীবের গীত - ২৩: ইনাহারা- সান-এর সাথে ডিনার
আমার অবস্থা গ্রামের সেই ভূমিহীন কৃষকের
মতো যে জীবনে একবার
জোতদারের বাড়িতে পোলাও খেয়ে জীবনভর ডানহাতের
তালুতে ঘিয়ের গন্ধ শুঁকে ফিরতো।
আমি সেই কবে ক'
দিনের জন্যে জাপানে গিয়েছিলাম, এখনও সেই গল্প
ফুরাচ্ছে না (এও যেন
আরব্য উপন্যাসের আলিফ লায়লা ওয়া
লায়লা নামের এক হাজার এক
রাত্রির কাহিনী, যা শেষ হয়েও
শেষ হয় না !)।
তা শেষ যখন হয়নি
তখন চলতে থাকুক - - ।
রেডিও জাপানে আমার এক সিনিয়র
ছিলেন হিন্দি সার্ভিসের মি. ইনাহারা বা
ইনাহারা- সান ( জাপানে নারী - পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে সান সম্বোধন করা
হয় তা অনেকেই জানেন
) । তিনি ভালো হিন্দি
জানতেন বলে বাংলাও মোটামুটি
বুঝতে পারতেন, ফলে কোনোদিন বাংলা
বিভাগে প্রযোজক না থাকলে ইনাহারা-
সান সেই দায়িত্ব নিতেন।
হিন্দির সাথে বাংলার সখ্য
ছাড়াও, আমি দীর্ঘদিন করাচিতে
থাকায় কাজ চালিয়ে নেয়ার
মতো উর্দু জানতাম আর হিন্দি এবং
উর্দু ভাষার মধ্যে যে কী পরিমাণে
মিল রয়েছে তাও সবার জানা
( আসলে বাংলা, হিন্দি আর উর্দু তিনটি
ভাষারই জন্ম এই উপমহাদেশে
তাই মিল থাকাটাই স্বাভাবিক
) । ইনাহারা- সান হিন্দি শেখার
জন্য বেশ কিছুদিন ভারতের
সম্ভবত এলাহাবাদে ছিলেন। সেখানে তিনি অনেক হিন্দি
মুভি দেখেন। এতে তার হিন্দি
ভাষায় দক্ষতা বেড়েছিল এবং একই সঙ্গে
তিনি হিন্দি গানের অনুরাগী হয়েছিলেন। তার সংগ্রহে অনেকগুলি
হিন্দি গানের অডিও ক্যাসেট ছিল,
আমাকে তিনি কুন্দনলাল সাইগলের
(K.L. Saigol.) জনপ্রিয়
গানের দুটি ক্যাসেট উপহার
দিয়েছিলেন। বস্তুত অবসর সময়ে তার
সাথে আমার গল্প খুব
জমতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তার তরুণ
বয়স, তার কাছে আমি
যুদ্ধের সময় ও যুদ্ধ-
পরবর্তীকালের অনেক গল্প শুনেছি।
আমি জাপানে থাকতেই তিনি চাকরি থেকে
অবসর গ্রহণ করেন। তিনি চেইন স্মোকার
এবং হুইস্কির প্রতি আসক্ত ছিলেন।
ইনাহারা- সানের অবসরগ্রহণ উপলক্ষে আমি তাঁকে একদিন
রয়েল বেঙ্গল রেস্টুরেন্টে ডিনারের দাওয়াত করলাম ( এই রেস্তোরাঁর কথাও
আগে অনেকবার বলেছি ) । তিনি রসিক
মানুষ, বললেন দুজন পুরুষ মানুষ
ডিনার করলে কি জমে
? একজন মহিলা থাকা চাই -- ।
অফিসে ছিলেন বাংলা বিভাগের সহকর্মী জয়শ্রী চট্টোপাধ্যায়, তিনি রাজি হলেন।
ইনাহারা- সান বললেন - তোমাদের
বেঙ্গলের চিকেন- তন্দুরি আর মাসালা- টি
( মসলা দেয়া দুধ চা
) অনেকবার খেয়েছি, ওতে আর আগ্রহ
নেই। ড্রিংকস কি থাকবে তাই
বলো। আমি বিপদে পড়ি।
বিশ্বাসের ক্ষেত্রে, নিজে মদ্যপান করা
আর অন্যকে পান করানোর মধ্যে
খুব একটা তফাত দেখি
না। জয়শ্রীদি উদ্ধার করেন। তিনি বললেন - ফুডের
দায়িত্ব মীর- সানের আর
ড্রিংকস আমার, কোনো সমস্যা নেই। তাই হলো,
হুইস্কির বিল তিনি পরিশোধ
করলেন। ( নিচের ছবিতে ডান পাশে আমি,
মাঝে ইনাহারা- সান আর বামে
মিসেস চ্যাটার্জি )।
তবে এ ধরণের খাওয়া
তো আর মুখ বন্ধ
করে হয় না। গল্পের
সাথে খাওয়া কিংবা খাওয়ার সাথে সাথে গল্প
চলতে থাকে। ইনাহারা- সানের নানা প্রশ্ন। এখানে
যারা হালাল মাংস খেতে আসে
তাদের অনেকেই বিয়ার- হুইস্কিও পান করে, তাহলে
পোর্ক আর অ্যালকোহলের মধ্যে
তফাত কি, এখানে যে
নন- অ্যালকোহলিক বিয়ার পাওয়া যায় তা পান
করে কি হয় - ইত্যাদি।
গোঁড়া মুসলিম পরিবারে আমার জন্ম, তা
ছাড়া ছোটবেলায় কয়েক বছর মাদ্রাসায়
পড়েছিলাম, হয়তো সেই সংস্কার
সারা জীবনে কাটিয়ে উঠতে পারিনি। জাপানে
যাওয়ার সময় মনে মনে
বলেছিলাম - দেশে যা করিনি
বিদেশেও তা করবো না,
দেশে যা খাইনি বিদেশেও
তা খাবো না। শতভাগ
সফল হয়তো হইনি ( তা
সম্ভবও নয় ) , তবু চেষ্টা তো
করেছি - এই সান্ত্বনা ।
গতকাল ছিল রবীন্দ্রজয়ন্তী ।
এই মহামানবের কথা দিয়েই শেষ
করি –
আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর
উড়িবার ইতিহাস।
তবু, উড়েছিনু এই মোর উল্লাস।
[ ইনাহারা- সান-এর সাথে ডিনার- জনাব হাসান মীরের রেডিও জাপানের স্মৃতিচারণ। যা তাঁর ফেসবুক থেকে সংগ্রহ করা হলো। ]